সাফাত বিন ছানাউল্লাহ: চট্টগ্রামকে বীরের চট্টলা বলা হয়। নামেই যার পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। দেশখ্যাত গুণীদের মধ্যে অনেকেই জন্মেছেন বিপ্লবীদের তীর্থভূমিতে যাদের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে থাকবে আজীবন। কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, মহা মনীষী, শিল্পী, অভিনেতা, সংগঠকদের জন্মভূমি বিপ্লবতীর্থ ভূমি চট্টলায়। যারা আপন কর্মে উদ্ভাসিত হয়ে আজ বিশ্বব্যাপী পরিচিত। ইতিহাস সমৃদ্ধ চট্টগ্রামে রয়েছে গর্ব করার মতো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বিখ্যাত আঞ্চলিক গান দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে গেছে বিশ্বের আনাচে কানাচে। কবিয়াল আসকর আলী পণ্ডিত, রমেশ শীলরা তাদের কবিগান, আঞ্চলিক, মাইজভাণ্ডারী, মারফতি গান দিয়েতো অমর থাকবেন আজীবন। পরবর্তীতে জীবন্ত কিংবদন্তি
আব্দুল গফুর হালী, সৈয়দ মহিউদ্দিন, এম এন আকতার, মলয় ঘোষ দস্তিদার, মোহন লাল দাশ, লক্ষীপদ আচার্য সহ আরো অনেক কিংবদন্তি গীতিকার, সুরকার, শিল্পীরা এই সংস্কৃতিকে নিয়ে গেছেন বিশ্বদরবারে। চট্টলার গানকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করার মুল কারিগর ছিলেন রাজা-রাণী খ্যাত প্রয়াত শ্যামসুন্দর বৈঞ্চব ও শেফালী ঘোষ।
তাদের মহাপ্রয়াণের পর যাদের মাধ্যমে ধারাবাহিকতা এখনো টিকে আছে তাদের মধ্যে অন্যতম সংস্কৃতি জগতের পরিচিত মুখ আমার ছোট মামা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের বর্তমান অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী শহীদ ফারুকী। তিনি শুধু আঞ্চলিক গানেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। নিয়মিত গেয়ে যাচ্ছেন, পল্লীগীতি, আধুনিক, মাইজভান্ডারি সহ বিভিন্ন ঘরানার গান। খুব অল্প বয়সেই যার গানের হাতেখড়ি। শিশুশিল্পী হিসেবে বাংলাদেশ বেতারে গান গেয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই গানের সাথেই বন্ধুত্ব। বিশেষ করে চট্টলার গানের প্রতি রয়েছে বিশেষ সখ্যতা। ১৯৭৫ সালের ১৫ ই জুন ইতিহাসের তীর্থভূমি বীর পটিয়ার কচুআই ফারুকী পাড়াতে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ ফারুকী। পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, পটিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও স্নাতক ডিগ্রী শেষ করার পাশাপাশি বাবা মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর, লেখক, প্রাবন্ধিক মিয়া আবু মোহাম্মদ ফারুকী, মা রতœগর্ভা মহীয়সী রোকেয়া বেগম সহ পরিবারের অনুপ্রেরণায় একজন শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজস্ব ধারায়। পটিয়ার স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে গানের হাতেখড়ি। বড় ভাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতিমান ছবির শিল্পী শোয়েব ফারুকী।
শ্যাম-শেফালীর রেখে যাওয়া গানগুলো সহ নিজের মৌলিক গান টেলিভিশন, বেতার ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সহশিল্পীর সাথে জুটি বেধে পরিবেশনা করেন নিয়মিত। সহশিল্পীদের মধ্যে তারকা শিল্পী কোহেলী আকতার, অনামিকা মনি , জুলি, সুপ্রিয়া মজুমদার, শারমিন চৌধুরী, শর্মিলা শারমিন, সোনিয়া হায়দার মুন্নী, গীতা আচার্য্য, মুন্নী আকতার মারিয়া, নাজনীন মোস্তারী, তমালিকা কর্মকার প্রমুখ। বাংলাদেশ টেলিভিশন (চট্টগ্রাম কেন্দ্র), মোহনা টিভি, বাংলা টিভি সহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে চাটগাঁইয়া গান গেয়ে সারা দেশে চট্টলার ঐতিহ্যকে পরিচিত করার ক্ষেত্রে ভুমিকা রাখছেন। কণ্ঠে গেঁথেছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গানের পাশাপাশি মৌলিক গান। চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকে জাতীয়, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিয়ে যেতে এই ধারা চলমান রেখেছে।
চট্টগ্রামের এক সময়ের জনপ্রিয় অডিও প্রতিষ্ঠান আমিন স্টোর থেকে শহীদ ফারুকীর ১১টি গান নিয়ে প্রথম মিউজিক ভিডিওর অ্যালবাম বের হয়েছে। গানগুলো লিখেছেন এম এন আলম, উত্তম কুমার আচার্য ও এস এম ফরিদুল হক। অন্যান্য জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে, রফিক আশিকীর কথা ও সুরে ' হত হইলাম রাঙামাটি লই যাইয়ুম ফাল্গুনে, পাহাড়ি বাঙালির হোয়ারে লই বেড়াইয়ুম সাম্পানে, সনজিত আচার্যের কথা ও সুরে " দাওয়াত দিলাম তোঁয়ারে চাটগাঁ বেড়াইতা আইয়, " চলো যাই রাঙামাটি আঁরা দুনজন " উত্তম কুমার আচার্যের কথা ও সুরে " ভোরের শিউলী " ' পহেলা বৈশাখ ' এস এম ফরিদুল হকের কথা ও সুরে রংধনুতে রাঙা নীল আকাশ, হরেক পাখি শীতল বাতাস, " টুপটাপ বৃষ্টি " এক্কই পাড়াত'। দেশের গান " ঘুম ভাঙলেই পাখির গান, চোখ খুললেই সোনার ধান, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে " যার ডাকেতে ঘর ছাড়িলাম, যার কথাতে অস্ত্র ধরলাম " নিজের লেখা - " কোন রূপসী হেটে যায়, নাম ঠিকানা জানা নাই, বাঁকা চোখে চেয়ে আমার মন নিল ইশারায় " অসম্ভব জনপ্রিয় একটি গান। কিংবদন্তিদের গানগুলো ছাড়াও সনজিত আচার্য্য, উত্তম কুমার আচার্য, এস এম ফরিদুল হক, মিলন আচার্য, হুমায়ুন চৌধুরী সহ চট্টলার নামকরা গীতিকার, সুরকারের গান গেয়েছেন।
একজন শিল্পীর পাশাপাশি তিনি অনুষ্ঠান পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রগ্রাহক ও অভিনেতা হিসেবেও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। অভিনয়শিল্পী হিসেবে প্রখ্যাত পরিচালক নুরুল ইসলাম নুরুর " মন চোরা মাঝি " টেলিফিল্মে অভিনয় করেন। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত নিয়মিত শিল্পী হিসেবে গান গেয়ে চলছেন অবিরাম। সঙ্গীতের বর্ণাঢ্য অগ্রযাত্রায় চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও বেশ কয়েকটি সংগঠনে যুক্ত থেকে শুদ্ধ সংস্কৃতিতে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। শুদ্ধ সংস্কৃতিতে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেছেন একাধিক সম্মাননা। কর্মজীবনে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের প্রথম সারীর চক্ষু হাসপাতাল " পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন। আগামীর পথে আরো সমৃদ্ধ হোক ছোট মামা শহীদ ফারুকীর পথচলা। লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও সংগঠক।